প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা:
বাংলা চিরকালই কৃষিপ্রধান দেশ। প্রাচীনকালে অধিকাংশ মানুষই গ্রামে বাস করতো আর গ্রামের আশপাশের ভূমি চাষ করে সংসার চালাতো । তাই এদেশের অর্থনীতি গড়ে উঠেছে কৃষির ওপর নির্ভর করে । ধান ছিল বাংলার প্রধান ফসল। এ ছাড়া, পাট, ইক্ষু, তুলা, নীল, সরিষা ও পান চাষের জন্য বাংলার খ্যাতি ছিল। ফলবান বৃক্ষের মধ্যে ছিল আম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি, ডালিম, কলা, লেবু, ডুমুর, খেজুর ইত্যাদি । এলাচি, লবঙ্গ প্রভৃতি মসলাও বঙ্গে উৎপন্ন হতো। গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরু, ছাগল, মেষ, হাঁস-মুরগি, কুকুর ইত্যাদি ছিল প্রধান । লবণ ও শুঁটকি দেশের কোনো কোনো অংশে উৎপন্ন হতো ।
কুটির শিল্পে প্রাচীন বাংলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল । গ্রামের লোকদের দরকারি সব কিছু গ্রামেই তৈরি হতো । মাটির তৈরি জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল কলস, ঘটি-বাটি, হাঁড়ি-পাতিল, বাসনপত্র ইত্যাদি। লোহার তৈরি জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল দা, কুড়াল, কোদাল, খন্তা, খুরপি, লাঙ্গল ইত্যাদি । এছাড়া জলের পাত্র, তীর, বর্শা, তলোয়ার প্রভৃতি যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হতো । বিলাসিতার নানা রকম জিনিসের জন্য স্বর্ণ-শিল্প ও মণি-মাণিক্য শিল্প অনেক উন্নতি লাভ করেছিল । কাঠের শিল্পও সে সময়ে অত্যন্ত উন্নত ছিল। সংসারের আসবাবপত্র, ঘর-বাড়ি, মন্দির, পাল্কি, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, রথ প্রভৃতি কাঠের দ্বারাই তৈরি হতো । এছাড়া নদীপথে চলাচলের জন্য নানা প্রকার নৌকা ও সমুদ্রে চলাচলের জন্য কাঠের বড় বড় নৌকা বা জাহাজ তৈরি হতো ।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান হলেও অতি প্রাচীনকাল থেকে এখানে নানা প্রকার শিল্পজাত দ্রব্য তৈরি হতো। বস্ত্র শিল্পের জন্য বাংলা প্রাচীনকালেই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল । বিশ্বখ্যাত মসলিন কাপড় প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় তৈরি হতো এ বস্ত্র এত সূক্ষ্ম ছিল যে, ২০ গজ মসলিন একটি নস্যির কৌটায় ভরা যেত । কার্পাস তুলা ও রেশমের তৈরি উন্নতমানের সূক্ষ্ম বস্ত্রের জন্যও বঙ্গ প্রসিদ্ধ ছিল। শণের তৈরি মোটা কাপড়ও তখন প্রস্তুত হতো । জানা যায় যে, বঙ্গদেশে সে সময় টিন পাওয়া যেত । বঙ্গে কৃষি ও শিল্পদ্রব্যের প্রাচুর্য ছিল । আবার এগুলোর খুব চাহিদাও ছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে । তাই বঙ্গের সঙ্গে প্রাচীনকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চলত । বঙ্গের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সুতি ও রেশমি কাপড়, চিনি, গুড়, লবণ, তেজপাতা ও অন্যান্য মসলা, চাল, নারকেল, সুপারি, ঔষধ তৈরির গাছপালা, নানা প্রকার হীরা, মুক্তা, পান্না ইত্যাদি ।
শিল্পের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যও যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল। স্থল ও জল উভয় পথেই বাণিজ্যের আদান-প্রদান চলত । দেশের ভেতরে বাণিজ্য ছাড়াও সে সময়ে বাংলা বৈদেশিক বাণিজ্যে বিশেষ উন্নত ছিল। স্থল ও জলপথে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বাংলার পণ্য বিনিময় চলতো। এ কারণে বাংলার বিভিন্ন স্থানে বড় বড় নগর ও বাণিজ্য বন্দর গড়ে উঠেছিল । এগুলো হলো- নব্যাবশিকা, কোটীবর্ষ, পুণ্ড্রবর্ধন, তাম্রলিপ্ত, কর্ণসুবর্ণ, সপ্তগ্রাম ইত্যাদি । অবশ্য শহর ছাড়া গ্রামের হাটবাজারেও কিছু কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো। এসব গ্রামের হাটে গ্রামে উৎপন্ন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বেচাকেনা হতো। সমুদ্রপথে সিংহল, ব্রহ্মদেশ, চম্পা, কম্বোজ, যবদ্বীপ, মালয়, শ্যাম, সুমাত্রা, চীন প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাংলার পণ্য বিনিময় চলতো। স্থলপথে চীন, নেপাল, ভুটান, তিব্বত ও মধ্য এশিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল।
শিল্পের উন্নতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের ফলে বাংলার ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্য প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছিল । প্রাচীনকালে হয়ত ক্রয়-বিক্রয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ‘বিনিময় প্রথা' প্রচলিত ছিল । সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের পূর্বে বাংলায় মুদ্রার প্রচলন আরম্ভ হয় । বিভিন্ন সময়ে বঙ্গদেশে বিভিন্ন প্রকার মুদ্রা চালু থাকলেও এখানে কড়ি সবচেয়ে কম মান হিসেবে ব্যবহৃত হতো ।
শিল্পকলা ও স্থাপত্য-ভাস্কর্য:
বাংলাদেশের নানাস্থানে প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পের বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। নানা কারণে এসব শিল্পকলা ধ্বংস হয়ে গেছে। তবুও নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্রাচীন যুগে বাংলার শিল্পকলা খুবই উন্নত ছিল ।
স্থাপত্য : প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন অতি সামান্যই আবিষ্কৃত হয়েছে। চীন দেশের ভ্রমণকারী ফা-হিয়েন ও হিউয়েন-সাংয়ের বিবরণী এবং শিলালিপি থেকে প্রাচীন যুগে বাংলার কারুকার্যময় বহু হৰ্য্য, (চূড়া, শিখা) মন্দির, ভূপ ও বিহারের কিছু পরিচয় পাওয়া যায় । বাংলাদেশের স্থাপত্যের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হচ্ছে বৌদ্ধ স্তূপ। গৌতম বুদ্ধের দেহের হাড় বা তার ব্যবহার কর জিনিসপত্রের ওপর স্তূপ নির্মাণ করা হতো। পরে জৈন ধর্মাবলম্বীরাও ভূপ নির্মাণ করতো। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস ও বিদ্যাচর্চা করার জন্য বিহার নির্মাণ করতো। নওগ জেলার পাহাড়পুরে অবস্থিত সোমপুর মহাবিহার পাল যুগে নির্মিত হয়েছিল। এছাড়া, কয়েক বছর পূর্বে কুমিল্লা জেলার ময়নামতিতে কয়েকটি বিহারের সন্ধা পাওয়া গেছে। এটি শালবন বিহার নামে পরিচিত।
ভারতীয় স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাসে প্রাচীন বাংলার মন্দির এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। প্রাচীনকালে অসংখ্য মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। এ সকল মন্দির পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট, রাঢ়, বরেন্দ্র প্রভৃতি অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। প্রস্তর ও ধাতু নির্মিত দেব-দেবীর মূর্তি এ যুগের শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে বিবেচিত হয়। মূর্তি নির্মাণে সাধারণত অষ্টধাতু ও কষ্টিপাথর ব্যবহার করা হতো। এছাড়া, সোনা ও রুপার ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়।
অতি সম্প্রতি উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামে প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন এক নগর সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। নরসিংদী জেলার বেলাব, শিবপুর ও রায়পুরা উপজেলার ৫০টি স্থান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাথর ও প্রস্তরীভূত জীবাশ্ম-কাঠের হাতিয়ার, তাম্রপ্রস্তর সংস্কৃতির প্রত্নবস্তু। উয়ারী-বটেশ্বর ছিল বাংলাদেশের প্রাচীনতম নগরী। এখান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে মাটির দুর্গ-প্রাচীর, পরিখা, পাকা রাস্তা, পার্শ্ব-রাস্তাসহ ইটনির্মিত স্থাপত্য কীর্তি। পুরাতন ব্ৰহ্মপুত্র নদ অববাহিকায় অবস্থিত উয়ারী-বটেশ্বর ছিল একটি নদীবন্দর ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র । এখানে বিকশিত হয়েছিল স্বল্প-মূল্যবান পাথরের নয়নাভিরাম পুঁতি তৈরির কারখানা। এখানে আবিষ্কৃত উপমহাদেশের প্রাচীনতম ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা ও মুদ্রাভাণ্ডার, অনন্য স্থাপত্যকীর্তি, হরেক রকমের পুঁতি, সুদর্শন লকেট ও মন্ত্রপূত করচ, বাটখারা, পোড়ামাটির ও ধাতব শিল্পবস্তু, মৃৎপাত্র, চিত্রশিল্প ইত্যাদি শিল্পীর দক্ষতা, উন্নত শিল্পবোধ ও দর্শনের পরিচয় বহন করে ।
বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি বৌদ্ধধর্ম প্রচারক ও পণ্ডিত অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের প্রাচীন বজ্রযোগিনী গ্রামে সম্প্রতি একটি বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ মনে করছেন এটি অষ্টম বা নবম শতকে নির্মিত বিক্রমপুরী বৌদ্ধ বিহার। বিক্রমপুর থেকে আবিষ্কৃত তাম্রশাসন, দারু (কাঠ) ও পাথর নির্মিত ভাস্কর্য, স্মৃতির প্রভৃতি প্রত্নবস্তু থাক মধ্যযুগের সমৃদ্ধ সভ্যতার পরিচয় বহন করে ।
ভাস্কর্য : প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য শিল্পের পাশাপাশি ভাস্কর্য শিল্পের চর্চাও হতো। প্রাচীন বাংলায় বহু মন্দির ছিল। তাই ভাস্কর্য শিল্পকলাও যে উন্নত ছিল তাতে সন্দেহ নেই। অনেক স্থানে মন্দির ধ্বংস হলেও তার মধ্যের দেব-দেবীর মূর্তি রক্ষিত হয়েছে। পাহাড়পুরের মন্দির পাত্রে খোদিত পাথর ও পোড়ামাটির ফলক থেকে বাংলার নিজস্ব ভাস্কর্য শিল্পের বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। খোদিত ভাস্কর্য ছাড়াও প্রাচীন বাংলায় পোড়ামাটির শিল্প খুবই উন্নত ছিল। কুমিল্লার ময়নামতি ও লালমাই পাহাড়ে বেশ কিছু পোড়ামাটির ফলক ও মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।
চিত্রশিল্প : পাল যুগের পূর্বেকার কোনো চিত্র আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কিন্তু প্রাচীনকালেই যে বাংলায় চিত্র অঙ্কনের চর্চা ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সাধারণত বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরের দেয়াল সৌন্দর্যময় করার জন্য চিত্রাঙ্কন করার রীতি প্রচলিত ছিল । তখনকার দিনে বৌদ্ধ লেখকরা তালপাতা অথবা কাগজে তাদের পুস্তকের পাণ্ডুলিপি তৈরি করতেন। এ সকল পুঁথি চিত্রায়িত করার জন্য লেখক ও শিল্পীরা ছোট ছোট ছবি আঁকতেন ।
রেখার সাহায্যে চিত্রাঙ্কনেও প্রাচীন বাংলার শিল্পীরা যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন। রাজা রামপালের রাজত্বকালে রচিত 'অষ্টসাত্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা' পুঁথি বাংলার চিত্রশিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। রেখার সাহায্যে চিত্রাঙ্কনের আর একটি দৃষ্টান্ত হলো সুন্দরবনে প্রাপ্ত ভোম্মনপালের তাম্রশাসনের অপর পিঠে উৎকীর্ণ বিষ্ণুর রেখাচিত্র ।
বাংলা ভাষাসাহিত্য:
উদ্ভব ও বিকাশ অস্ট্রিক ছিল বাংলার আদি অধিবাসীদের ভাষা। এ ভাষা আর্যদের আগমনের পর ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। আর্যদের ভাষার নাম প্রাচীন বৈদিক ভাষা। পরবর্তীকালে এ ভাষাকে সংস্কার করা হয়। পুরনো ভাষাকে সংস্কার করা হয়েছে বলে এ ভাষার নাম হয় সংস্কৃত ভাষা। অনেকে বলেন, সংস্কৃত ভাষা থেকেই বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আধুনিক পণ্ডিতগণ তা মেনে নেননি। প্রাচীন যুগে আর্যদের যে ভাষায় বৈদিক গ্রন্থ রচিত হয়েছিল স্থানভেদে এবং সময়ের বিবর্তনে তার অনেক পরিবর্তন ঘটে। সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত এবং প্রাকৃত থেকে অপভ্রংশ ভাষার উৎপত্তি হয়। অপভ্রংশ ভাষা থেকে অষ্টম বা নবম শতকে বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয়। যেমন : কৃষ্ণ > কানু > কানাই ।
বাংলা ভাষার এরূপ প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক নেপাল থেকে সংগৃহীত চর্যাপদে। এ চর্যাপদগুলোর মধ্যেই বাংলা সাহিত্যের জন্ম হয় । বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাপদগুলোর মূল্য অপরিসীম।